সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:১৬ পূর্বাহ্ন
জিকির উল্লাহ জিকু:
মাস্কই হলো করোনা থেকে বাঁচার অন্যতম পথ। কথা বলার সময়, হাঁচি, কাশির সময় মুখ-নাক থেকে বেশকিছু তরলবিন্দু বেরিয়ে আসে। এই তরলবিন্দুকে ড্রপলেট বলে। কিন্তু করোনা থেকে বাঁচার এই অন্যতম পথ মাস্ক পরিধান করতে অনিহা সাধারণ মানুষ থেকে সচেতন মানুষের মাঝে দেখা যায় কক্সবাজার শহরে।
চলতি সপ্তাহের কয়েকদিন পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সবকিছু চলছে সেই আগের মতোই স্বাভাবিক। অফিস-আদালত, ব্যাংক, শপিং মলে আর হাটে-বাজারে বেশির ভাগই মানুষ মাস্ক ব্যবহার করছেন না। আর যারা করছেন তারা অফিসে বা চিকিৎসা করতে গিয়ে সেবা বঞ্চিত হবে এই ভয়ে। গণপরিবহন, শপিংমল, মাছ বাজার, সৈকত পাড়, সদর হাসপাতাল আর জেলার বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা যায় করোনার আতঙ্ক কেটে ভয় নাই কারো মাঝে। করোনা নিয়ে ভীতি নাই কক্সবাজারে। জেলা প্রশাসন সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন বিভিন্নভাবে জনগণের মাঝে মাস্ক ব্যবহারে সচেতনতার জন্য। কক্সবাজার পৌরসভার পক্ষ থেকেও রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাস্ক ব্যবহারের সতর্কতা ও সচেতনতা সৃষ্টির জন্য মাইকিং করা হচ্ছে কয়েকদিন ধরে।
করোনা পরিস্থিতি কক্সবাজারে সহনীয় পর্যায়ে আছে, তবে সবার উচিত মাস্ক ব্যবহার করা–
ডা.অনুপম সেন,অধ্যক্ষ কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
উপজেলার গ্রামে-গঞ্জের মানুষের মুখে মাস্ক ব্যবহার দেখা গেলেও বেশির ভাগ মানুষের মুখে এখন আর মাস্ক চোখে পড়ে না। করোনা প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে এখানেও জেলা প্রশাসনের তৎপরতাও বেশ লক্ষণীয়। তার পরেও সবখানে মাস্ক ব্যবহার জনসাধারণের মাঝে নিশ্চিত করা যাচ্ছেনা। তবে স্বস্তির খবর জেলাজুড়ে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আছে। মানুষ আতঙ্কে নাই স্বস্তিতে আছে।
কক্সবাজার সিভিল সার্জন সূত্র জানান, জেলায় এপর্যন্ত (৮ নভেম্বর) মোট আক্রান্ত ৬ হাজার ৪৬০, সুস্থ ৪ হাজার ৬৩৭,মৃতের ৮১ জন এর মধ্যে রোহিঙ্গা ৯ জন, জেলায় করোনা নমুনা সংগ্রহের সংখ্যা ১ লাখ ৭৩৯৪ জন।
বিশিষ্ট জনের অভিমত সাম্প্রতিক সময়ে কক্সবাজার পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি এখন সুস্থ। গত ১ সেপ্টেম্বর দুপুরের দিকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাবেক জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শাহাজাহান করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এর আগে কক্সবাজার ডিসি কলেজের কহিউর আক্তার (অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর) মারা যান। এতসব দুঃসংবাদের মধ্যে জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন এর সহধর্মীনিও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। যাদের মৃত্যুর বার্তা আর আক্রান্তের খবর করোনা নিয়ে হেলাফেলা নয় জানান দিচ্ছে করোনার ভয় একেবারেই চলে যায়নি।
কথা হয় কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মাসুদুর রহমান মোল্লা’র সাথে তিনি কক্সবাজার ভয়েসকে বলেন, কয়েকদিন আগেই জেলা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হয়েছে। তাতে অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে কক্সবাজার পৌরসভাসহ সকল পৌরসভা, উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে জনগণের মাঝে মাস্ক ব্যবহারের বিষয়ে সর্বোচ্চভাবে সচেতনতা সৃষ্টি করা। তিনি বলেন আসন্ন শীত মৌসুম সামনে রেখে জনসাধারণ যেন প্রশাসনের নির্দেশনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে অফিস আদালতে আসেন। কারণ মাস্ক ব্যবহার করোনার অন্যতম একটি অষুধ। এরই মাঝে ১ লক্ষ মাস্ক বিতরণও করা হবে জনসাধারণের মাঝে। তিনি আরো বলেন, দেখা যায় শহরে বের হলেই মাস্ক ছাড়া মানুষের ছড়াছড়ি। তাই জনগণ যেন মাস্ক ব্যবহারকে অবহেলা না করে।
জেলা জুড়ে মাস্ক ব্যবহারে অবহেলা:
প্রায় জায়গায় দেখা যায়, নো মাস্ক, নো সার্ভিস। তবে সবখানে মানা হয়না। বেশির ভাগই এটা দায় এড়াতে লাগিয়ে দেন। গতকাল দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে নীচের তলায় সিঁড়িতে দেখা দুই দিকেই সতর্কতা সাইনবোর্ড নো মাস্ক নো সার্ভিস। তদারকির জন্য দুইজন কর্মচারীও রয়েছেন। একজনের মুখে মাস্ক নাই আরেকজনের মুখে মাস্ক আছে। মাস্ক নাই কেন জানতে চাওয়া হলে লাল গেঞ্জি পরিহিত ছেলেটির কোনো জবাব নাই। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দেখা যায়। দু তলার বারান্দায় অনেক সেবা প্রার্থী মানুষ। কারো মুখে মাস্ক আছে কারো মুখে নাই। কারো আছে পকেটে, আবার কারো থাকলেও মুখে থেকে নামিয়ে ফেলেছে। দু’তলা আর ৩ তলার বেশ কয়েকটি অফিসে গিয়ে দেখায় যায় অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে মাস্ক ছাড়া। তবে সবাই ভালোভাবে কাজ করছেন স্বাভাবিক নিয়মে।
পাশেই রয়েছে আইনজীবী ভবন এখানেও দেখা যায় প্রায় একই রকম চিত্র। কোনো মক্কেলের কাছে মাস্ক আছে। আবার কোনো আইনজীবীর মুখে মাস্ক নাই। তবে অস্বস্তিও নাই। স্বাভাবিকভাবেই সবকিছু কর্মসম্পাদন হচ্ছে। কথা হয় একজন আইনজীবীর সাথে তিনি বলেন, এখানে সবাই সচেতন। কক্সবাজারে করোনা প্রায় স্বাভাবিক। তাই মানুষের মনে এখন করোনার ভয় আগের মতো নাই। যার কারণে এই আস্থা থেকে এই চিত্র।
বাটা বাজার, মেডিসিন মার্কেট, পাশের শপিং মল, সমবায় মার্কেট, বার্মিজ মার্কেট সহ সবখানে ব্যবসায়ীদের কারো মুখে মাস্ক দেখা যায়। ক্রেতারা ক্রয়ের মাস্ক ছাড়া ঢুকলে মানাও করছেন না আবার অস্বস্তিও রাখছেন না। কথা হয় মেডিসিন মার্কেটের মেডিসিন দোকানের মালিকের সাথে তিনি বলেন, ‘আমরা যতটুকু পারছি স্বাস্থবিধি রক্ষা করে বিক্রি করছি। ক্রেতারা যদি মাস্ক ছাড়া আসে অষুধ বিক্রি না করে পারিনা। হাসিমুখে বলেন বুঝতে পারছেনতো ওরাই তো আমারদের লক্ষী।’সমবায় মার্কেটের কাপড় কিনতে আসা এক হাবিব-শাহিনা দম্পতি বলেন, ‘মাস্ক অনেক্ষণ পড়েছি। বেশিক্ষণ পড়লে অস্বস্তি লাগে তাই এখন খুলে ফেলেছি। করোনার ভয় নাই জানতে চাইলে বলেন, এখনতো ভালো পরিস্থিতি মনের ভেতর একটা আস্থা আছে জানান। যা তাদের নির্ভয়ে ঘুরতে বাধা হচ্ছেনা।
একটু পরেই বড় বাজারের গলির মুখে দেখা হয় এক রিক্সাওয়ালার। রোদ থেকে বাঁচতে মাথায় হেড কিন্তু করোনা থেকে বাঁচতে মুখে মাস্ক নাই জানতে চাইলে বলেন, ‘ভাই পেটের জন্য এতসব নিয়ম মানতে পারিনা। করোনা ভয় নাই উল্লেখ করে বলেন,সব কিছুর মালিক আল্লাহ এই গরীবের মালিকও আল্লাহ। তিনিই রক্ষা করবেন। দেখা যায়, শহরের টমটম, সিএনজি, রিক্সার ড্রাইভারদের মাঝে মাস্ক ব্যবহারের কোনো সচেতনতা নাই। পাশাপাশি যাত্রীদে মাঝেও এই সচেতনতা পরিলক্ষিত হয়নি। যার কারণে এই আসন্ন শীতে একপ্রকার ঝুঁকি রয়ে যাচ্ছে এমন অভিমত সচেতন মহলের।
কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডা. অনুপম সেন কক্সবাজার ভয়েসকে জানান, ‘করোনা পরিস্থিতি কক্সবাজারে সহনীয় পর্যায়ে আছে। তবে আরো সচেতন এবং সতর্ক হতে হবে। জেলাজুড়ে বেশির ভাগ মানুষই মাস্ক ব্যবহার করছেন না এতে ঝুঁকি কী পরিমাণ এমন প্রশ্নে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটাই সবচেয়ে বেশি দুঃখের বিষয়।তিনি জোর দিয়ে বলেন, মাস্ক ব্যবহার না করার কোনো বিকল্প নেই। মাস্ক ব্যবহারের উপকারিত অনেক বেশি। এটা অন্তত নিজেকে সুরক্ষা করে। আক্রান্ত হলেও পরিমাণে কম। ডায়বেটিকস্ আর হার্টের রোগিরা মাস্ক ব্যবহার না করলে করোনার উচ্চ ঝুঁকি থাকে উল্লেখ করে আরো বলেন জনগণের আরো উচিত মাস্ক ব্যবহারে সচেতন হওয়া। প্রত্যেককেই মাস্ক পড়ে বের হওয়া,শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা বাধ্যতামূলক করা উচিত বলে জানান বর্তমান সময়ে।’
স্বাস্থ্য বিভাগের মতে শীত মৌসুমে করোনার সংক্রমণ বাড়তে পারে, আর দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা আগেই করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সেই অনুযায়ী সরকারও নিচ্ছে নানা প্রস্তুতি, রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনাও। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু প্রস্তুতি নিলেই চলবে না, সেগুলো জনগণকে মানাতে হবে, প্রয়োজনে বাধ্য করাতে হবে।
মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিতে অভিযানে প্রশাসন:
মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিতে অভিযানে নেমেছে জেলা প্রশাসন। রবিবার (৮ নভেম্বর) সুগন্ধা পয়েন্ট এলাকায় করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল আইন ২০১৮ অনুযায়ী ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় এ জরিমানা করেন জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশণার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মাহমুদুর রহমান৷
এ সময় বারবার তিনি অনুরোধ করেন, নির্দেশনা ও সতর্ক করার পরেও মাস্ক না পরায় ১৪ টি মামলায় ৭ হাজার ৬০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।
এছাড়াও মাস্কবিহীন পর্যটকদের মাস্ক কিনে পরিধান করতে অনুরোধ করা হয় এবং প্রতিটি দোকানে ক্রেতাদের জন্য একটি মাস্ক এর বক্স ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখার ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের নির্দেশনা প্রদানপূর্বক এরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে সে বিষয়ে সতর্ক করা হয়।
মাস্ক পড়ুন, নিজে সুস্থ থাকুন, অপরকে নিরাপদ রাখুন এ শ্লোগানে সবার মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির পাশপাশি এ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অব্যাহত থাকবে বলে ও জানান তিনি।
ভয়েস/আআ